গত আগস্টে পশ্চিমাপন্থী আশরাফ গনি সরকারের পতনের পর তালিবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানি কর্তপক্ষের মধ্যে বিজয়োল্লাস লক্ষ্য করা যায়।এছাড়াও তালিবান ক্ষমতা দখলের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আফগানিস্তানের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে পাকিস্তানের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়।
নতুন তালেবান সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেয়ার জন্য পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করেন। তবে কয়েক মাস পার না হতেই দুই কর্তৃপক্ষের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতেই পাকিস্তানের তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ নতুন আফগান সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য আফগানিস্তান সফর করেন। বিশ্লেষকদের মতে তার এই সফরের প্রধান উদ্দেশ্যে ছিলো নতুন তালিবান সরকারে পাকিস্তানপন্থী হাক্কানী নেটওয়ার্কের কর্তৃত্ব বজায় রাখা এবং পাকিস্তানের প্রতি বিরূপ মনোভাবের অধিকারী হিসেবে পরিচিত মোল্লা আব্দুল গণি বারাদার যাতে নতুন সরকারের প্রধান না হতে পারেন তা নিশ্চিত করা। উল্লেখ্য যে মোল্লা আব্দুল গণি বারাদার ২০১০ থেকে ২০১৮ প্রায় ৮ বছর পাকিস্তানের কারাগারে আটক ছিলেন। ফয়েজ হামিদের এই সফরের মধ্য দিয়ে নতুন তালিবান মন্ত্রীসভায় হাক্কানী নেটওয়ার্ক মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ পদবি দখল করতে সক্ষম হয় এবং এর মাধ্যমে পাকিস্তান তার নিজস্ব প্রভাব বলয়ের সামর্থ্যের জানান দেয়।
তবে সাম্প্রতিক সময় দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সীমান্ত সমস্যা ছাড়াও পাকিস্তান তালিবানের ( টিটিপি) প্রতি আফগান তালিবানের একচ্ছত্র সমর্থন দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
পাকিস্তান কর্তৃক সীমান্তে তারকাঁটার বেঁড়া দেয়ায় আফগান কর্তৃপক্ষের মধ্যে প্রবল বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে। পশতুন অধ্যুষিত সীমান্তবর্তী এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া দেয়ায় পশতুনদের মধ্যে পাকিস্তান বিরোধী অনুভূতি নতুন করে জাগ্রত হচ্ছে। তারা মনে করছে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্যই কাঁটাতারের এই বেড়া। তালিবান কতৃপক্ষের মনোভাব মূলত পশতুনদের মনোভাবেরই প্রতিধ্বনি। ডুরান্ড লাইন নামে পরিচিত সীমান্তটি মূলত এখনো দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এক অমীমাংসিত বিষয়। ১৮৯৩ সালে আমির আব্দুল রহমান ও ব্রিটিশ ফরেইন সেক্রেটারি মর্টিমার ডুরান্ডের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত এবং আফগানিস্তানের সীমানা নির্ধারিত হয়। তবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর এই একই সীমানা অনুসারে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যকার সীমানা নিরূপণ করা হয় যদিও শুরু থেকেই এই ব্যাপারে আফগানিস্তানের ব্যাপক বিরোধিতা ছিলো। সাম্প্রতিককালে এই সীমানা নিয়েই আবার দুই দেশের মধ্যে নতুন করে বিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত টিটিপি'র প্রতি আফগান তালিবানের নিরবিচ্ছিন্ন সমর্থন এবং টিটিপি কর্তৃক পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায়, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে। পাকিস্তানের দাবি অনুযায়ী টিটিপি'র ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে পাকিস্তানের প্রায় ৮০,০০০ বেসামরিক লোক প্রাণ হারায় এবং ১৫০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অন্যদিকে দখলদার পশ্চিমাদের হটাতে আফগান তালিবানের পাশে ছায়ার মতোই ছিলো টিটিপি। আগস্টে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর আফগানিস্তানে আটক অসংখ্যা টিটিপি বন্দীকে মুক্তি দেয় আফগান তালিবান। ২০১৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক টিটিপি'র বিরুদ্ধে সর্বগ্রাসী আক্রমণে নামা হয় এবং টিটিপি'র শক্তি ব্যাপকহারে ক্ষুণ্ণ করা হয়। ২০০৮ সালে আত্মপ্রকাশ করা টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নিরাপত্তার অভাব বোধ করলে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে আফগানিস্তানের ভূমিকে ব্যবহার করতে পারে।
২০২১ সালে আফগান তালিবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় পাকিস্তানে টিটিপির আক্রমণ বিপুলভাবে বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে কর্মরত চীনা শ্রমিক এবং চীনের রাষ্ট্রদূতকে লক্ষ্য করে টিটিপির আক্রমণ সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য।
সীমান্ত এবং টিটিপি উভয় সমস্যারই কোনো সহজ সমাধান লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা, অদূর ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে উপনীত হয় তা সময়ই বলে দেবে।
Subscribe to our newsletter
Join our monthly newsletter and never miss out on new stories and promotions.