আজ - ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ১০, ২০২৪ ১০:১৬:০৮

নবাব সলিমুল্লাহ ও বাংলার ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস | History of the fate of Nawab Salimullah and Bengal

রাকিবুল হাসান
- শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
10 Nov, 2021
The Bangla Reader

ভারতবর্ষের সবচেয়ে misunderstood এই মহান নেতা জন্ম গ্রহণ করেছিলেম ঢাকার বিখ্যাত নবাব পরিবারে ১৮৭১ সালের জুন মাসে। বিখ্যাত এই নবাব পড়াশোনার দীক্ষা নেন ব্রিটিশ শিক্ষকদের নিকট। পরবর্তীতে কর্মজীবনে তিনি ময়মনসিংহে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। পিতার মৃত্যুর পর নবাব সলিমুল্লাহর বড় ভাই হাফিজউল্লাহর নবাব হওয়ার কথা ছিলো তবে অকালে মৃত্যু বরণ করায় নবাব হন নবাব সলিমুল্লাহ। নবাব সলিমুল্লাহ প্রথম বিয়ে করেন পিতার অনিচ্ছায়, এই কারণে পিতার সাথে তার দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এই দূরত্বের কথা নবাব পরিবারের ডায়রির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবুও পরবর্তীতে সন্তানের প্রতি পিতার স্নেহের ঘাটতি দেখা যায়নি কখনো।



নবাব সলিমুল্লাহ যখন নবাব হন তখন ভারতীয়  উপমহাদেশ তার ক্রান্তিকালীন সময় অতিবাহিত করছিলো। কংগ্রেসের ছায়াতলে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা নিজেদেরর অধিকার আদায়ে তখন ব্যাপক সোচ্চার। কংগ্রেসের এই আন্দোলন-সংগ্রামে যদিও গুটি কয়েক মুসলমান নেতার উপস্থিতি ছিলো।

নিজেদের স্বার্থে ব্রিটিশ শাসকেরা বাংলাকে দুইভাগে ভাগ করে, এই বঙ্গভঙ্গে সমর্থন ছিলো নবাব সলিমুল্লাহ সহ পূর্ববঙ্গের আপামর জনসাধারণের যদিও অপর বাংলার কায়েমি শক্তি এই বঙ্গভঙ্গকে কখনো মেনে নিতে পারেনি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রাখীবন্ধনের ডাক দেন। এই কথা পরবর্তীতে প্রতীয়মান হয়েছে যে রাখীবন্ধন মূলত মুসলিম বর্জনের ভিন্ন নামান্তর। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং পরবর্তীতে নিজের এই ভুল বুঝতে পারেন। 



বঙ্গভঙ্গ হওয়ার ফলে পূর্ব বাংলায় ও আসামে উন্নতি ও জাগরণের এক নতুন ঢেউ ওঠে যা এই দুই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আত্ম উন্নয়নে ব্যাপক সুযোগ - সুবিধার সৃষ্টি করে। 

বঙ্গভঙ্গের ফলে অপর বাংলার যদিও খুব একটা সমস্যা হয়নি তবুও কেবল নিজেদের হীন কায়েমি স্বার্থের কারণে তারা নতুন সৃষ্ট প্রদেশের তীব্র বিরোধিতা করে। এই বিরোধীতার জের ধরে বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বিদেশি পণ্য বর্জনের নামে এই উপমহাদেশে নগ্ন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন যার ফলে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং অন্যান্য শ্রেণীর জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। পিছিয়ে পড়ে নিজেদের আকাঙ্ক্ষিত উন্নতি। 



এই ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ রাজ কায়েমের পর থেকেই নানা সংগঠনের সূচনা ঘটে, ১৮৪৩ সালে ল্যান্ড হোল্ডারসদের সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়, একই বছর নীলকরদের সংগঠনেরও যাত্রা শুরু হয়। ১৮৬৩ যাত্রা শুরু হয় নবাব আব্দুল লতিফের সংগঠন 'মহামেডান লিটারেরি সোসাইটি' এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষিত  মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্যের শিল্প-সমঝদারদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। এর আগে স্যার সৈয়দ আহমদ খান আরও একটি সংগঠনের সূচনা করেছিলেন। তবে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কংগ্রেসের ঢেউয়ে অন্যান্য ছোট ছোট সংগঠন গুলো আত্মবিস্মৃতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে থাকা নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শিতা এবং মুসলমানদের প্রতি বৈরী আচরণের ফলে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের যাত্রা শুরু হয়। ১৯০৬ সালের ২৭ ই ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করা এই সংগঠন সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলমানদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো। কংগ্রেস নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হবে এই ভয়ে মুসলিম লীগের যাত্রা মেনে নিতে পারেনি। কংগ্রেস নেতারা মুসলমানদের নেতৃত্ব দুর্বল করার জন্য পরবর্তীতে কতিপয় মুসলমান নেতা নিয়ে 'ইন্ডিয়ান মুসলিম এসোসিয়েশন' নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেন। এই দলটির সহ সভাপতি ছিলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ। ভাগ্যের কী পরিহাস এই মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বেই পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। 



নবাব সলিমুল্লাহ নিজের নবগঠিত রাজনৈতিক দলটির ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। পূর্ববঙ্গের মানুষের জন্য তিনিই সর্বপ্রথম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার দাবী করেছিলেন। এছাড়া শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য তিনি অসংখ্যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি বৃহৎ অনুদান প্রদান করেন। এই অঞ্চলের মানুষের জন্য ১৯০৬ সালেই ট্রামওয়ের আবেদন জানান নবাব সলিমুল্লাহ । সিলেটের সাথে শিলঙের যোগাযোগের জন্য রেলওয়ে নির্মাণের আবেদন জানান। হীনমন্যতায় ভোগা মুসলিম মানসের উন্নয়নের স্বার্থে নানা কর্মপদ্ধতির অবতারণা করেন। কোলকাতার যাতে মুখাপেক্ষী না হতে হয় এইজন্য স্বাবলম্বী হিসেবে নিজ অঞ্চলকে গড়ে তোলার জন্য যাবতীয় সকল ধরনের কর্মপরিকল্পনা তিনি নিয়েছিলেন।



কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ দুই দলের নেতৃবৃন্দই ইংরেজদের সাথে আপোষের ভিত্তিতে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। নবাব সলিমুল্লাহও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। 

হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হিংসাত্মক আন্দোলনের ফলে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হোন, পিছিয়ে পড়ে অবহেলিত পূর্ব বাংলা, নানা কর্মপরিকল্পনা সবকিছু  ভেস্তে যায় বঙ্গভঙ্গ রোধের ফলে। এই পাঁচ বছর 'বিদেশি পণ্য বর্জনের নামে যে আন্দোলন হয় এতে পিছিয়ে পড়ে বাংলার শিল্পখাত আর এই সুযোগ ব্যাপক লাভবান হয় মাড়োয়ারিরা, তারা এই সুযোগের সৎ ব্যবহার করে এবং তারা শিল্পখাত সহ ব্যবসায়ের অন্যান্য দিক দিয়েও ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রতিপত্তি অর্জন করেন।



১৯১১ সালে অবশেষে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হোন তবে ইংরেজরা প্রতিশোধ হিসেবে ভারতবর্ষের রাজধানী কোলকাতা থেকে একসময়ের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করেন। এর ফলে বাঙালি জাতি ভারতবর্ষে তার প্রভাব চিরদিনের জন্য হারায়।



রিলেটেড পোস্ট / আরো পড়ুন

Subscribe to our newsletter

Join our monthly newsletter and never miss out on new stories and promotions.