উনিবিংশ শতাব্দির তৃতীয় দশকের ইতিহাস। সবে মাত্র কলকাতার গোড়াপত্তন হলো। ভারতে কোম্পানী রাজত্বের মধ্যভাগের দিকে এগিয়ে চলেছে । তখন ভারত এক অচেনা আতংক বা মহা দুর্যোগের দেশে পরিণত হয়েছিলো। কোন লোক ঘর থেকে বের হয়ে গেলে আর ফিরে আসে না , চিরতরে হারিয়ে যায়। নিরুদ্দেশ হওয়া তৎকালীন যুগে হওয়া খুব অবাক বিষয় ছিল না। মানুষ আগেও হারাতো এখনো হারায় ,কখনো ঘুরতে গিয়ে হারায় আবার কখনো মনের কষ্টে নিজে নিজেই হারিয়ে যায়।
কিন্তু এসব হারিয়ে যাওয়ার সাথে তৃতীয় দশকের হারানোর সাথে কোন মিল পাওয়া যায় না বলেও সন্দেহ হয় সবার মনে।কোম্পানী সিপাহীরা ঝাকে ঝাকে নিজ গৃহে ফিরে গিয়ে আর ফিরে আসে না। খোজ খবর না পেয়ে অফিসাররা তাদের নামের পাশে লাল কালি দিয়ে লিখে রাখে " পালিয়ে গেছে "। শুধু এখানেই নয় দক্ষিন ভারত থেকে মস্ত বড় একটি তীর্থযাত্রীর দল তীর্থে গিয়ে চিরতরে নিরুদ্দেশ। ব্রিটিশ সরকার ঘটনা প্রবাহকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করে।
পরে আস্তে আস্তে এর তীব্রতা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ সরকারের গলার কাটা হয়ে দাঁড়ায়। জনৈক ঐতিহাসিক হিসাব কষতে বসে হিসাব করে জানালেন গড় পর্তায় প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার লোক নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। এতো লোক কোথায় নিরুদ্দেশ হচ্ছে সে সম্পর্কে কোম্পানী সরকারের কোন ধারনা নেই। ব্রিটিশ সরকার প্রথমে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করেলেও পরে দেখা যায় আস্তে আস্তে ব্রিটিশরাও হারাতে শুরু করেছে। ১৮১২ সালে ব্রিটিশ সরকার "ঠগী" নামের একটি উগ্র ধর্মীয় সঙ্ঘবদ্ধ দলের কথা প্রথম জানতে পারে ।
সংস্কৃত ' ঠগ ' শব্দ থেকে আসা এর অর্থ ঠক, প্রতারক, ধুর্ত ,প্রবঞ্চক। মধ্য ভারতের কিছু এলাকা থেকে এরা উঠে এসেছে । এরা তাদের নিজের ভাষায় কথা বলতেন। তাদের ভাষার নাম ছিলো 'রামোসি'। জন্মগত ভাবেই এরা অপরাধী। ঠগীরা দলের সর্দারকে জমাদার নামে অভিহিত করত। ঠগিদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র ছিল পশ্চিমবাংলার ’কালীঘাট’ ও বিন্ধ্যাচলের ’ভবানী মন্দির’। সাধারণত বংশপরম্পরায় এরা হত্যাকাণ্ড ঘটাত। একজন ঠগী বালক ১৮ বছর হলে সে হত্যার অনুমতি পেত। এরা হিন্দু ধর্মের দেবতা "কালী "র পূজা করতো এবং সাধারন লোককে বলি দিয়ে তারা প্রায়শ্চিত্ত করতো।
ঠগীরা হত্যাকাণ্ডের জন্য একটি হলুদ রং এর রুমাল বা গামছা জাতীয় কাপড় ব্যবহার করত। হত্যার সময় একজনকে হত্যার জন্য তিনজন ঠগী থাকতো এদের একজন মাথা ঠেসে ধরত, একজন রুমালটি হত্যার শিকার ব্যক্তির গলায় পেঁচিয়ে ধরত এবং অরেকজন পা ধরে থাকত। ঠগীরা হত্যার পর লাশ গুলো মাটিতে পুঁতে ফেলত। কেউ পালিয়ে গেলে ঠগীদের অগ্রবর্তী দল তাদের হত্যা করত। তারা সাধারণত ভিক্ষুক, সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী, ঝাড়ুদার, তেল বিক্রেতা, কাঠমিস্ত্রি, কামার, বিকলাঙ্গ, কুষ্ঠরোগী, গঙ্গাজলবাহক ও নারীদের হত্যা করত না।
হাজার হাজার মানুষ হারিয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিক নির্দেশ প্রদান করেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হেনরি স্লীম্যানকে যাতে এর একটা সুরাহা করে এবং এই বিপদ থেকে ভারতকে উদ্ধার করে। নির্দেশ পেয়ে পুরো ভারত জুড়ে স্লীম্যান অভিযান পরিচালনা করে। ১৮৩৫ সালের স্লীম্যান " ফিরিঙ্গি " - " সৈয়দ আমির আলী" নামের একজন ঠগী নেতাকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তিনি স্লীম্যানকে ১০০ জনের গলায় ফাস দিয়ে হত্যা করা একটি গনকবরের খোজ দেয় এবং সে হত্যাকান্ডে কারা কারা জড়িত সবার নাম প্রকাশ করেন। স্লীল্যান ফিরিঙ্গি'র তথ্য অনুযায়ী পুনরায় অভিযান পরিচালনা করে এবং গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয় যাতে ঘটনার আগেই তথ্য পায়।
কিছু হিসেব অনুযায়ী ১৭৪০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত ঠগীরা ১০ লক্ষের বেশি মানুষ হত্যা করেছিল
অনেক বছর চেষ্টা করার পরে স্লীম্যান ঠগীদের আধ্যাত্মিক নেতা বাহরাম জমাদারকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। তিনি ৯৩১ টা শ্বাসরোধ করে হত্যা কান্ডের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলো। ১৮২৬ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ৪৫০০ এর অধিক ঠগীকে বিচারের আওতায় আনা হয়। তার মধ্যে ৩৮২ জনকে ফাসি , ৯০৯ জনকে নির্বাসন ,৭৭ জনকে সারাজীবনের জন্য জেল এবং অনেককেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে দেওয়া হয়। ১৯৩৯ সালে উইলিয়াম স্লীম্যান ঠগীদের চিরতরে ধংস করার আনুষ্ঠানিক ঘোষনা দেয়।
রিলেটেড পোস্ট / আরো পড়ুন
Subscribe to our newsletter
Join our monthly newsletter and never miss out on new stories and promotions.